ABOUT AUTHOR

Sunday, January 29, 2017

নির্যাতনের বর্ণনা শোনাল রোহিঙ্গারা

কফি আনান কমিশনের সদস্যরা গতকাল কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালীতে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন আইওএমসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা l প্রথম আলোকফি আনান কমিশনের সদস্যরা গতকাল কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালীতে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন আইওএমসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা l প্রথম আলো
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সে দেশের সেনাবাহিনী ও পুলিশের দমন-পীড়নের মুখে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দুটি শিবির পরিদর্শন করেছে কফি আনান কমিশনের প্রতিনিধিদল। তিন সদস্যের এই দলটি গতকাল রোববার কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের দুটি রোহিঙ্গাশিবিরে যায়। সেখানে রোহিঙ্গাদের মুখ থেকে নির্যাতনের বর্ণনা শোনে তারা।

কফি আনান কমিশনের প্রতিনিধিদলে রয়েছেন মিয়ানমারের নাগরিক উইন ম্রা ও আই লুইন, লেবানিজ নাগরিক ঘাশান সালামে। ঢাকা থেকে গতকাল সকালে কক্সবাজারে এসে প্রতিনিধিদলটি বেলা ১১টায় প্রথমে উখিয়া উপজেলার বালুখালীর জঙ্গলে গড়ে ওঠা রোহিঙ্গাশিবিরে যায়। সেখানে প্রায় এক ঘণ্টা অবস্থান করে তারা। শিবিরের ১৯ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে তারা।
প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ছিলেন ইউএনএইচসিআর (জাতিসংঘ শরণার্থী-বিষয়ক সংস্থা), আইওএম (আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা), পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মুখ থেকে আনান কমিশনের সদস্যরা রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি শুনেছেন। আজ সোমবার দুপুরে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক শেষে তাঁরা ঢাকায় ফিরে যাবেন।
আইওএম ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উখিয়ার শিবিরের রোহিঙ্গা গৃহবধূ নুর বেগম আনান কমিশনের সদস্যদের বলেছেন, গত ডিসেম্বরে রাখাইন রাজ্যের শিলখালী গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও পুলিশ। এতে তাঁর বাড়িসহ ২০-২৫টি বাড়ি পুড়ে যায়। সেনাদের গুলিতে নিহত হন অনেকে। তাঁর আত্মীয়দের অনেকে এখনো নিখোঁজ। প্রাণ বাঁচাতে তিনি অন্য রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সীমান্ত অতিক্রম করে এই শিবিরে আশ্রয় নেন।
রাখাইন রাজ্যের মরিচ্যা বিল এলাকার বাসিন্দা গুলিবিদ্ধ মোসলেহ উদ্দিন আনান কমিশনের প্রতিনিধিদলকে বলেন, ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে সেনা ও পুলিশ তাঁদের গ্রামটিও ঘিরে ফেলে গুলিবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে। ঘরের জিনিসপত্র লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়। মেয়েদের ধর্ষণ করে। গুলিতে আহত হন তিনি। পরে প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছাড়েন।
রাখাইন রাজ্যের অত্যাচার-নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরেন নাইছাপ্রু গ্রামের নুর জাহান, নুর আয়েসা, শিলখালী গ্রামের ফারেজা বেগম, ইয়াসমিন, বুচিডং গ্রামের রশিদ আহমদ, খেয়ারিপাড়ার আবুল কালামসহ আরও কয়েকজন।
উখিয়া থেকে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বেলা দুইটায় টেকনাফ উপজেলার লেদা রোহিঙ্গাশিবিরে (বস্তি নামে পরিচিত) যান। শিবিরের বিভিন্ন ঝুপড়িঘর (রোহিঙ্গারা থাকে) ঘুরে দেখেন তাঁরা। পরে লেদা রোহিঙ্গা বস্তির আইওএমের কার্যালয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা নির্যাতনের শিকার সাতজন রোহিঙ্গা নারী ও সাতজন রোহিঙ্গা পুরুষের সঙ্গে কথা বলেন তাঁরা।
শিবিরের বাসিন্দা মোহাম্মদ কামাল হোসেন আনান কমিশনের সদস্যদের বলেন, তাঁর বাড়ি রাখাইন রাজ্যের জামবনিয়া গ্রামে। নির্যাতনের মুখে পরিবারের আট সদস্যকে নিয়ে গত ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে লেদা রোহিঙ্গা বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বলেন, তাঁর চাচাতো ভাই মো. হাশিমকে হত্যা করার পর ভাতিজা অলি আহমদকে ধরে নিয়ে যান মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা। তাঁদের গ্রামে ৪০০ ঘরবাড়ি ছিল। এর মধ্যে ২০০-এর বেশি ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। গ্রামের অনেকে প্রাণে বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। তাদের সঙ্গে তিনিও পরিবার নিয়ে চলে আসেন। হত্যা, নির্যাতন বন্ধ হলে আবার নিজ গ্রামে তিনি ফিরে যেতে চান।
লেদা রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি দুদু মিয়া বলেন, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দিচ্ছে না। রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি দিলে বাংলাদেশে অবস্থান করা ও আশ্রয় নেওয়া সব রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যাবে।
গত বছরের ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের তিনটি পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার ঘটনায় ৯ পুলিশসহ ১৮ ব্যক্তি নিহত হয়। এরপর সে দেশের সেনাবাহিনী সেখানে অভিযান শুরু করে। আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় কয়েক হাজার ঘরবাড়ি। গৃহহীন প্রায় ৮০ হাজার রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার কয়েকটি রোহিঙ্গাশিবিরে আশ্রয় নেয়। এর আগে থেকে এসব শিবিরে অবস্থান করছিল মিয়ানমারের আরও অন্তত ৪ লাখ রোহিঙ্গা।
রাখাইন রাজ্যের জনগণের কল্যাণে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ তৈরির জন্য মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সু চি গত বছর জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানকে প্রধান করে একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করেন। রাখাইন রাজ্যের সব নাগরিকের মানবিক ও উন্নয়ন, নাগরিকত্ব, মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উপাদানগুলোকে নিয়ে কমিশন সুপারিশ তৈরি করবে। কফি আনান ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় মিয়ানমারের ছয় নাগরিক ও তিন বিদেশি বিশেষজ্ঞকে নিয়ে গঠিত এ কমিশন। 

0 comments:

Post a Comment

Hello